মার্কিন ও ভারত নির্ভরশীলতা কমানোর বিকল্প অঞ্চল আসিয়ান
১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ এএম

গত ৮ এপ্রিল মঙ্গলবার বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বাংলাদেশের রফতানির ওপর আমেরিকা যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে তার ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশকে তার রফতানির গন্তব্যস্থল আমেরিকা থেকে স্থানান্তর করে আঞ্চলিক বাজারসমূহে আনতে হবে। একথা সত্য যে, আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৬ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। কিন্তু আলোচ্য উদ্বৃত্ত ৬ বিলিয়নের অধিকাংশই যেহেতু এই শুল্ক খেয়ে ফেলবে সেজন্য বাংলাদেশকে এশীয় বাজারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আর এশীয় বাজারের মধ্যেও সুনির্দিষ্টভাবে গণচীন এবং ভারতের দিকে নজর দিতে হবে। একটি আলোচনা সভায় অধ্যাপক রেহমান সোবহানসহ অন্যান্য বক্তা একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন। তবে অধ্যাপক রেহমান সোবহান সুনির্দিষ্টভাবে বলেন যে, আমাদের রফতানির লক্ষ্যস্থল হবে পূর্বমুখী এবং আমাদের প্রতিবেশীদের মাঝেই। চীনে আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা আছে। ভারতেও এই সুবিধা আছে।
মার্কিন শুল্ক আরোপকে বিবেচনা করতে হবে আমাদের জন্য ওয়েক আপ কল (ডধশবঁঢ় পধষষ) হিসেবে। এখন আর আমাদের অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করলে চলবে না। এখন বরং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, এই উদ্বৃত্ত ৬ বিলিয়ন ডলারের কতখানি আমরা চীন এবং ভারতে রফতানি করে পুষিয়ে নিতে পারবো। এখন বাংলাদেশকে যেটা করতে হবে সেটি হলো বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং চীন ও ভারতের বাজারে আমাদের উপস্থিতি জানান দেয়া। এভাবে যদি আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি তাহলে মার্কিন বিনিয়োগও বাংলাদেশে আসবে। রেহমান সোবহান হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, বিশে^র বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৭০ শতাংশই রয়েছে এশিয়াতে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত মূলধন রয়েছে চীনে।
ভারতের ক্ষেত্রে তার বক্তব্য সঠিক নয়
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নাই। তবে তিনি রফতানি স্থানান্তরের জন্য শুধুমাত্র এশিয়ার দুইটি বড় দেশের কথা বলেছেন। এই দুটি বড় দেশের মধ্যে চীন আমাদের ইতোমধ্যেই যথেষ্ট শুল্ক ছাড় দিয়েছে। চীনে বাংলাদেশের রফতানির ৯৭ শতাংশই শুল্কমুক্ত। আর ভারতের কথা? এইখানে অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে অতিরিক্ত আশাবাদি বলে মনে হয়েছে। তার বক্তব্য অনেকটা স্বাপ্নিক। কারণ, ট্যারিফ এবং নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের টানাপোড়েন দুই যুগেরও বেশি। ভারত আমাদেরকে জিরো ট্যারিফ তো দূরের কথা, বর্তমান ট্যারিফ প্রাচীর (ওয়াল) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নামিয়ে আনতেই রাজি হচ্ছে না। সেখানে বাংলাদেশের রফতানি বাড়িয়ে উদ্বৃত্ত ৬ বিলিয়ন ডলারের আংশিক পুষিয়ে নেয়া এই মুহূর্তে বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না। চীনের বেলাও এই কথাটি আংশিকভাবে প্রযোজ্য। এই মুহূর্তে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হলো চীন এবং ভিয়েতনাম। সেখানে তৈরি পোশাককে জায়গা করিয়ে দিতে হলে ভিয়েতনাম এবং চীনকে তাদের রফতানি কমিয়ে দিতে হবে।
পূর্বমুখী নীতি ও আসিয়ানে যোগদান
সেজন্য বাংলাদেশের যেটি আশু করণীয় সেটি হলো, আমাদের রফতানিকে বহুমুখীকরণ। বাংলাদেশ বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের জন্য প্রধানত নির্ভর করে তৈরি পোশাক রফতানি এবং ফরেন রেমিট্যান্সের ওপর। এই দুটি খাতের আয় যত বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সাথে সাথে বাংলাদেশকে লুক ইস্ট বা পূর্বমুখী নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আর সেটি সম্ভব আসিয়ানে (অঝঊঅঘ) যোগ দেয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আসিয়ানে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেছে। আবেদনটি এখনো পেন্ডিং আছে। বর্তমানে আসিয়ানের সদস্যভুক্ত দেশ হলো ১১টি। এরা হলোÑ ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ব্রæনেই, থাইল্যান্ড, মিয়ানমান, ফিলিপাইনস, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া।
বিমসটেকে বাংলাদেশের খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ এখানকার মোড়লী ছাড়ল না ভারত। কিন্তু আসিয়ানে বাংলাদেশের রফতানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আসিয়ানের বাজার বিশাল। এই ১১টি দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ৬৮ কোটি। বাংলাদেশ যোগ দিলে হবে ৮৫ কোটি। বাংলাদেশের আবেদন যদি গৃহীত হয় তাহলে ওই ১১টি দেশ পাবে ১৭ কোটি মানুষের বাজার। আর বাংলাদেশ পাবে ৬৮ কোটি মানুষের বাজার। আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের সম্মিলিত জিডিপি হলো ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ান ডলারেরও বেশি। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ১০ মিলিয়নে ১ কোটি। ১ হাজার মিলিয়নে ১ বিলিয়ন। ১ হাজার বিলিয়নে ১ ট্রিলিয়ন। তাহলে হিসেব করে দেখুন তাদের জিডিপি কত বিশাল।
আজ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছে। ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে আমরা অনেক পণ্য আমদানি করি। মালয়েশিয়া আমাদের জনশক্তি রফতানির অন্যতম প্রধান ডেস্টিনেশন। এখানে আরো একটি কথা বলা দরকার যে, বাংলাদেশ আগামীতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে রফতানির বেলায় ৭ থেকে ১৪ শতাংশ শুল্ক ছাড় হারাতে হবে। সেক্ষেত্রে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং আরো রফতানি বৃদ্ধি করতে পারে আসিয়ানের সদস্য হয়ে।
রফতানির বাজার সম্প্রসারণ
আসিয়ান থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে সম্ভবত ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম তার ইলকট্রনিক পণ্যের মানোন্নয়ন করে আসিয়ানভুক্ত ১১টি দেশের রফতানি বাজার ধরে ফেলেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ওষুধ, তথ্য প্রযুক্তি এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত উপকরণ উৎপাদনে প্রায় পরিপক্কতার স্তরে পৌঁচেছে। বাংলাদেশ যদি আসিয়ানের সদস্য হতে পারে তাহলে এই তিনটি খাতের পণ্য আসিয়ান দেশে রফতানি করার মাধ্যমে আরো উন্নত ও বিকশিত হতে পারে।
ইউনিক ভৌগলিক অবস্থান
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ইউনিক। আমাদের দেশটি দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধন। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, এশিয়ান হাইওয়ে এবং চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের লজিস্টিক সাপোর্টের কেন্দ্রভ‚মি বানাতে পারে। বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখ তাই আসিয়ান দেশগুলো সংকীর্ণ সাগরের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বঙ্গোপসাগরের সুপরিসর এলাকায় প্রবেশের সুবিধা পাবে। আসিয়ানের সদস্য হওয়া এক দিকে বাংলাদেশের যেমন ভারত নির্ভরতা কমাবে অন্যদিকে তেমনি দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে কৌশলগত সুবিধা লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
তরুণ জনসংখ্যার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের ৩৫ বছরের কম বয়সী যুবকরা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। এই বিপুল তরুণ শক্তিকে স্বাস্থ্য সেবা, আইসিটি, নির্মাণ, শিল্প এবং কৃষিতে প্রশিক্ষিত করলে আসিয়ান দেশসমূহে তারা কর্মসংস্থান পেতে পারে। আবার একই সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে অবদান রাখতে পারে।
ওই যে বলে, লাস্ট বাট নট দি লিস্ট। সেটি হলো, ভারত বা আমেরিকার ওপের থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে হলে বাংলাদেশের রফতানির ডাইভারসিফিকেশন বা বহুমুখী করা ছাড়া গত্যন্তর নাই।
Email: journalist15@gmail.com
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিল স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন

কোটালীপাড়ায় ইজিবাইক চোর রুহুল আমিন গ্রেফতার

নিজ বাসায় থাকার অধিকার ফিরে পেলেন তুরিন আফরোজের মা

সুনামগঞ্জে ভারতীয় রুপিসহ বাংলাদেশী নাগরিক আটক

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা, সুপ্রিম কোর্টে অর্ধদিবস বন্ধ বিচারকাজ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে করাচি বন্দরে পৌঁছালো তুর্কি যুদ্ধজাহাজ

হাসনাতের গাড়িতে হামলা: গাজীপুরে রাতভর অভিযানে আটক ৭০

সরকার নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে সমাজে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা বাড়াছে: রাশেদ খান

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সীমান্তে ‘ফরোয়ার্ড হেডকোয়ার্টার’ করবে ভারত

ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন শাহরুখ,ভক্তদের উচ্ছ্বাস

সুদানে আরএসএফ-এর বর্বর হামলায় ৩০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত

হুথির ক্ষেপণাস্ত্র হামলা : ইসরায়েলে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট বাতিলের হিড়িক

ইমরান-বিলাওয়ালের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করল ভারত

শিক্ষক স্বল্পতা দুর করার আন্দোলনের সুযোগে ফ্যসিষ্টের দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ

আলিফ হত্যা মামলায় চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশ

রাবিতে তদন্তে গড়িমসি: অভিযুক্ত শিক্ষকের “রক্ষাকবচ” রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধেই সদস্যের পদত্যাগ

গাজায় আরও আগ্রাসী হামলার পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসরাইল, হাজার হাজার নতুন সেনা তলব

ভারতের দুঃসাহসে ঐক্যবদ্ধ জবাব দিতে প্রস্তুত পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী

বেরোবিতে যৌন হয়রানি: অভিযোগকারী সেই শিক্ষার্থী এখন নিরাপত্তাহীনতায়, মধ্যস্থতার প্রস্তাব

আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা